ধর্ষণ কমানোর উপায়
খুব কনফিউশনে ছিলাম, প্রবন্ধটার নাম “ধর্ষণ কমানোর উপায়” দেব নাকি “ধর্ষণ প্রতিরোধের উপায়” রাখব। ভাবনাচিন্তা করে দেখলাম, এই রোগটার প্রতিরোধের উপায় নেই, বরং যদি খানিকটা দমিয়ে রাখা যায় তাতেও অনেক। সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতি ঘন্টার চার থেকে বারোটা রেপ হয়। দুঃখের বিষয় কি জানেন? আপনি যখন এই লেখাটা পড়ছেন, সেই মুহুর্তেও দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে একটি মেয়ে ধর্ষিতা হচ্ছে। কিন্তু তার চিৎকার আমার আপনার কানে পৌঁছাবে না। যদি রাস্তায় মোমবাতি নিয়ে নামেন, হয়ত সেই রাস্তার পাশের গলিতেই একটি মেয়ের সর্বনাশ হচ্ছে। মোমবাতির আলো নিভে যাবে, কিন্তু মেয়েদের চোখের জল ফুরাবেনা। নিজেই হিসেব কষে দেখুন, কাল অবধি প্রিয়াঙ্কার জন্য প্রতিবাদ করছিলেন, আজ আবার মালদায় আরেকজন যুবতীর জীবন্ত দগ্ধ মৃতদেহ পাওয়া গেল। একই দিনে উত্তর প্রদেশে আরেকটি গনধর্ষিতা মেয়েকে জ্যান্ত জ্বালাবার চেষ্টা করা হল। তাই প্রতিরোধ করা না গেলেও যদি ঘন্টায় চারটে ধর্ষণের জায়গায় একটা ধর্ষণ হয়, যদি কিছুদিন বাদে দু’ঘন্টা বাদে একটা ধর্ষণ হয় তবে একটা দিন আসবে, যেদিন হয়ত চব্বিশ ঘন্টায় একটি মেয়েরও রেপ হবেনা। সেটাই হবে ভারতবাসী হিসাবে আমাদের জয়। উপায়গুলোর মধ্যে কয়েকটা সময় সাপেক্ষ, কয়েকটা কাল থেকেই প্রয়োগ করা সম্ভব। সবগুলো একসাথেই বলি।
1. #সিনেমাকে_বাস্তবে_পরিণত_করাঃ Theri নামের একটা দক্ষিনী ছবি দেখেছিলাম। সেখানে হোম মিনিস্টারের ছেলে একটি মেয়ের ব্রুটালি রেপ করে, অনেকটা নির্ভয়া স্টাইলে। সিনেমাটির নায়ক একজন পুলিশ অফিসার। সে ক্রিমিনালকে ধরে জেলে রাখার বৃথা চেষ্টা না করে, তাকেও যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করে। এই প্রথম কোনো সিনেমার সিন দেখে উত্তেজনায় তালি মেরেছিলাম। বাস্তবেও দেখবে, রেপিস্টদের মধ্যে অধিকাংশ নেতা মন্ত্রীদের ছেলে অথবা মন্ত্রীরা নিজেই। তারা জানে, যতই রেপ হোক, ঠিক আইনের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাবে, এমনকী জেলে গেলেও পুলিশ প্রোটেকশন পাবে। পুলিশ যদি প্রোটেকশন দেবার বদলে তাদেরকে জেলের মধ্যেই নির্মমভাবে হত্যা করে, দুদিনে দেশের চিত্র অনেকটা বদলে যাবে। পুলিশদের অনেক ক্ষমতা, কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা ঘুষ খাওয়া বাদে বাকী ক্ষমতাগুলোর প্রয়োগ সঠিকভাবে করতে পারলনা। ধর্ষণ কমাতে সর্বপ্রথম সৎ পুলিশদের একজোট হতে হবেই।
2. #মেয়েদের_নিজেকে_রক্ষা_করতে_শেখাঃ অনেকে বলে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে ব্যাগে একটা pepper spray অথবা ছুড়ি রাখতে। এটা ফলপ্রসূ হলেও, আমার মনে হয় ততটা লাভদায়ক নয়। যদি চারজন তোমায় চেপে ধরে, তুমি কি তাদের অনুরোধ করবে, “দাঁড়াও ভাই আগে pepper spray টা বের করে চোখে ছেটাই”… পেপার স্প্রে অথবা ছুড়ি চালাতে গেলেও তোমায় তৎপর হতে হবে, স্পিড বাড়াতে হবে, আর সেটা একমাত্র তোমায় দিতে পারে মার্শাল আর্ট। সপ্তাহে মাত্র দুদিন দু’ঘন্টা করে কোনো ক্যারাটে বা তাইকোন্ডোর সেন্টারে যদি এখন থেকেই ভর্তি হয়ে যাও, মাস ছয়েকের মধ্যে তুমি নিজেই পরিবর্তন দেখতে পাবে। ভেবে দেখো, যদি প্রতিটা যুবতী তার ব্যাগে পেপার স্প্রের বদলে একটা করে নানচাকু রাখতে শুরু করে এবং সেটা চালাতে দক্ষ হয়ে যায়, চারজন কেন দশজনও কাছে ঘেঁষতে পারবেনা। ছোট থেকে শেখানো হয় রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে হাঁটতে যাতে গাড়ী ধাক্কা না মারে। শেখানো হয় ট্রেনে অপরিচিত ব্যক্তির হাত থেকে খাবার না খেতে। অর্থাৎ নিজেকে সুরক্ষিত রাখার শিক্ষা ছোট থেকেই দেওয়া হয়। তাহলে মার্শাল আর্ট কেন শেখানো হয়না? স্কুলে পিটি শেখানো হয়। পিটি শিখলে লাভের লাভটা কি হয় আজ অবধি আমার মাথায় ঢোকেনি। বরং প্রতিটা গার্লস স্কুলে এখন থেকেই ক্যারাটে শেখানো শুরু করা হোক। তাতে মেয়েও ফিট থাকবে, চর্বি ঝরবে, কর্মদক্ষ হবে।
3. #মেয়েরাই_মেয়েদের_শত্রু_কেনঃ সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে খেয়াল করেছি, “ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী” মার্কা উৎকট মন্তব্য বেশীরভাগ মাসি-কাকীমা জাতীয় মহিলারাই করে। বাইরের দেশগুলোয় বিভিন্ন ন্যুড বিচ রয়েছে। সেখানে মেয়েরা সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় শুয়ে থাকলেও কেউ তাদের স্পর্শ করেনা। সমস্যাটা কাপড়ে নয়, এদের মানসিকতায়। আর এসব মানসিকতাই পরোক্ষভাবে ধর্ষকদের আশকারা দেয়। আসিফা টুইঙ্কেলদের মত বাচ্চা মেয়ের পোশাকে অথবা গত বছরে রেপ হওয়া ৭০ বছরের দিদিমার পোশাকেও ও হয়ত এরা নোংরামি খুঁজে পান। একজন মহিলা আমায় মেসেজ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ক্যারাটে শিখলে তাঁর ক্লাস ২ তে পড়া বাচ্চা মেয়েটির হাইমেন ফেটে যাবার ভয় আছে কিনা। হাইমেন ফাটলে তাঁর মেয়ে ভার্জিনিটি হারাবে, যদি বড় হলে মেয়ের বিয়ে না হয়। এই ধরণের মানসিকতা দয়া করে বদলান। না বদলাতে পারলে দয়া করে আত্মহনন করুন, পৃথিবী থেকে আবর্জনা কমবে।
4. #ধর্ষিতা_হওয়া_লজ্জার_নয়ঃ কথাটা লিখতে গিয়ে আমারই কষ্ট হচ্ছিল, তবুও কেন লিখলাম জানো? ৭০% ধর্ষিতা মহিলারা লজ্জায় এবং সমাজের ভয়ে পুলিশে কেস অবধি করতে ভয় পায়। ফলে ধর্ষকরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং অপর আরেক মেয়ের সর্বনাশ করে। ক্রাইম করাটা নেশার মত, তুমি লজ্জায় যদি প্রথমবারই তাকে নিরস্ত্র না করো, তাহলে সে সেই অপরাধটা আবার করবে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় মেয়ের ধর্ষণের জন্য তুমি দায়ী থাকবে। লজ্জা পেওনা, লড়াই করো। আমাদের সমাজ ধর্ষককে শাস্তি দেয়না, ধর্ষিতাকে শাস্তি দেয়। তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করে। এমন সমাজকে ভয় কিসের? আমি জানি, এই লেখাটা যতজন মেয়ে পড়ছে তাদের মধ্যে সিংহভাগ জীবনে একদিন না একদিন মলেস্ট হয়েছে। কিন্তু তারা সেকথা বলবেনা। লজ্জায়। Game of thrones এ একটা সংলাপ ছিল, “Never forget what you are. The rest of the world will not. Wear it like armor, and it can never be used to hurt you.”
5. #আইন_ব্যবস্থার_আমূল_পরিবর্তন_করাঃ বাংলাদেশ কিছুদিন আগে একজন রেপিস্টকে ফাঁসি দেয় এবং কটাক্ষ করে, “এটাকে ভারত পেয়েছ যে ভেবেছ রেপ করে ছাড়া পেয়ে যাবে?” কতটা লজ্জার বিষয় এটা আমাদের কাছে। আমার মতে ফাঁসি নয়, ধর্ষককে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেওয়া প্রয়োজন। ফাঁসি তো খুনের জন্যেও দেওয়া হয়, তাও খুন তো হচ্ছেই। কিন্তু মৃত্যুদন্ডের সাথে যদি দৃষ্টান্তমূলক যন্ত্রণা দেওয়া হয়, এবং সেটা গণমাধ্যমে লাইভ দেখানো হয়, একদিনে রেপের হার কমে যাবে। নিদেনপক্ষে ফাঁসির আইনটাই প্রণয়ন ও বাস্তবায়ণ করা দরকার এই মুহুর্তে। সমবেত ভাবে সরকারকে চাপ দেওয়া উচিৎ। তাতেও যদি না হয়, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিৎ। আদালতে অপরাধ প্রমাণ হবার পরে রেপিস্ট যতই পুলিশ প্রোটেকশন পাক, হাজার হাজার লোক যদি জমায়েত হয়ে রেপিস্টকে ছিনিয়ে আনে, তারপর জ্যান্ত অবস্থায় তার ছাল ছাড়িয়ে তন্দুরী বানায়, তাতে আরও বেশি কাজ দেবে। মনে হয় সেই দিন আসতে আর বেশি দেরী নেই। কারণ আইনের ওপর ব্যক্তিগতভাবে আমার আস্থা নেই। নাবালক হবার দোহাই দিয়ে যে আইন নির্ভয়ার ধর্ষককে সেলাই মেশিন দিয়ে ছেড়ে দিতে পারে, যে আদালত ধর্ষিতাকে প্রশ্ন করতে পারে, “ধর্ষণের সময় পা ফাঁক করে রেখেছিলে কেন” সেই আইনকে ভরসা মূর্খেও করবেনা।
6. #ছেলেরা_নায়ক_হওঃ নায়ক কাকে বলে জান? যে দুর্বলকে রক্ষা করে এবং অপরাধীকে ধ্বংস করে। নির্ভয়া পাবলিক প্লেসে ধর্ষিতা হল। তার গোপনাঙ্গে রড ঢুকিয়ে ভেতরটা ঘেঁটে দেওয়া হল। তখন চারপাশে একজনও “নায়ক” ছিলনা তাঁকে বাঁচানোর জন্য। কাল থেকে রাস্তায় বেড়োলে যদি দেখতে পাও কোনো মেয়েকে অন্য ছেলে টোন টিটকিরি কাটছে, নোংরা মন্তব্য করছে, তাঁকে সজোরে থাবড়াও। মারতে মারতে ফেসবুকে লাইভ করো। তোমার কোনো বন্ধুও যদি একটি মেয়ের প্রতি নোংরা মন্তব্য করে, তার সাথে বন্ধুত্ব আজই ত্যাগ করো। তবেই তুমি আসল নায়ক। মাথায় রাখবে মেয়েদের দেখা অন্যায় নয়, তাঁকে ভালো লাগা অন্যায় নয়, তার প্রতি কামুক হওয়াও অন্যায় নয়। এটা বায়োলজিকাল স্বভাব, মেয়েরাও পছন্দসই ছেলেকে দেখে কামুক হয়। কিন্তু সেই মেয়েটাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ছোঁব, এই ভাবনাটা রাখা অন্যায়। এই ভাবনাকেই রেপিস্ট মেন্টালিটি বলে। আমি রেপিস্টদের ভয় পাইনা, রেপিস্ট মেন্টালিটির মানুষদের ভয় পাই। তাদের বিরুদ্ধে ছেলেদেরকেই গর্জে উঠতে হবে। নায়ক হতে হবে।
7. #শিক্ষা_ব্যবস্থার_পরিবর্তন_ঘটানোঃ দেশটা এত বেশী অশিক্ষিতে ভরে গেছে, আজকাল রেপ হলে লোকে হিসেব কষতে বসে, মেয়েটি হিন্দু ছিল নাকি মুসলিম। রেপিস্টদের মধ্যে কজন হিন্দু, কজন মুসলিম। নিজের মাঝেমাঝে লজ্জা হয়, কাদের সাথে বাস করছি। আমার মতে, সব স্কুল কোএড করা উচিৎ এবং উভয়কে একই সাথে সে.ক্স এডুকেশনের ক্লাস করানো উচিৎ। এতে বাচ্চারা ছোট থেকেই বুঝবে ছেলে আর মেয়ে আলাদা নয়, একই রকম। মেয়েদের প্রতি নোংরা দৃষ্টি দেবার পরিমাণ অনেকটা কমে যাবে। শেখানো উচিৎ good touch আর bad touch এর পার্থক্য। ধর্ষণ এবং তার শাস্তি নিয়ে আলাদা একটা চ্যাপ্টার বানানো দরকার। মেন্টালিটি অনেকাংশে পরিবর্তন হতে বাধ্য। আমাদের সমাজ সবসময় ছেলে আর মেয়ের মেলামেশা কুনজরে দেখে। ছেলে মেয়ে একসাথে হাত ধরে হাঁটলে সেটা খারাপ। হোটেলে গেলে পুলিশের হাঙ্গামা, পার্কে প্রেম করলেও খবরদারি। অ্যাডাল্ট ওয়েবসাইট দেখলে সরকারের নাক গলানো, এমনকী পতিতালয়ে গেলে তাতেও শাস্তি। এগুলোর জন্য তো রেপ করার মেন্টালিটি আরও বাড়ে। যেকোনো হিউম্যান সাইকোলজি বিশেষজ্ঞকে প্রশ্ন করো, তারাও একই কথা বলবে। যারা নিজেরা নিজেদের প্রেমিকা, অ্যাডাল্ট ভিডিও বা পতিতালয়ের সাথে সুখী আছে, সুস্থভাবে নিজের কাম প্রশমিত করার উপায় বেছে নিয়েছে, তাদের কাঠি করার দরকারটা কি? আমাদের দেশে এগুলোর জন্য শাস্তি রয়েছে, কিন্তু রেপ করার জন্য শাস্তি নেই। আইনব্যবস্থার তৃতীয় চরণে পুনরায় সাষ্টাঙ্গে প্রণাম।
সর্বোপরি, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিজের সাবধানতার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে ভরসা কোরোনা। ক্যারাটে যদি ভালো নাই লাগে, তাহলে pepper spray অন্তত সাথে রাখো, যদি কাজে দেয়। নিদেনপক্ষে ইউটিউব দেখে কিছু সেলফ ডিফেন্স টেকনিক শিখে রাখো এবং প্রতিদিন প্র্যাকটিস করো। কথা দিচ্ছি বিপদের দিনে সেই টেকনিকটাই সবচেয়ে বেশী কাজে আসবে। ছেলেদেরকেও দায়িত্ব নিতেই হবে উঠতি রেপিস্টদের মেন্টালিটি শুধরানোর। সাথে রেপ হলেই হিন্দু-মুসলিমের হিসেব কষা পশুগুলোকেও মানুষ করতে হবে। আজ নিজে নিরাপদে আছো বলে যদি বাকী মেয়েদের বিপদকে তাচ্ছিল্য করো, তবে একদিন হয়ত তোমারও বোন দিদি বা গার্লফ্রেন্ডকে একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে, হতে পারে। চলো না, একসাথে একজোট হয়ে দেশটা বদলাবার দায়িত্ব নি। দুর্গা যতদিন না চন্ডীরূপ ধারণ করতে পারছে, ততদিন অবধি শিবকে রুদ্ররূপ ধারণ করতেই হবে।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন